ধর্ম ডেস্ক:
সারাদেশে যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-আজহা উদযাপিত হয়েছে।
করোনা মোকাবেলায় ও সংক্রমণ বিস্তার রোধে সরকারের নির্দেশনায় এবার খোলা মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়নি। সারাদেশের ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয় মসজিদের ভেতরে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে।
নামাজ শেষে মোনাজাতে দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা হয়। করোনার কারণে মুসল্লিরা কোলাকুলি থেকে বিরত থাকলেও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন একে অন্যের সাথে।
প্রত্যেক মসজিদে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থাও ছিলো। পাশাপাশি সম্প্রতি বৈশ্বিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও নিহতদের জন্য দোয়া করা হয়। করোনা থেকে মুক্তির জন্য মুসল্লিরা আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানান।
আরও পড়ুন
আবু বকর রায়হান:
আবির রহমান। চার বছর বয়সে সে তার মা-বাবাকে হারায়। তার জায়গা হয় স্থানীয় এতিমখানায়। বর্তমানে এই এতিম খানাই বহন করছে আবিরের সমস্ত খরচ। কিন্তু এতিম খানার আয়ের উৎস কি? যার সাহায্যে এতিমখানাগুলা আবিরের মতো অসহায় শিশুদের দায়িত্ব নিয়ে থাকে।
এতিমখানাগুলোর আয়ের বড় অংশ আসে মৌসুমি চামড়া থেকে। আর এই মৌসুমি চামড়ার বড় যোগান আসে কোরবানী পশুর চামড়া থেকে। যার টাকা দিয়ে চলছে আবিরের মতো অসহায় এতিম শিশুদের পড়াশুনা।
কিন্তু বর্তমানে চামড়ার ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার কারণে অসহায় শিশুদের দায়িত্ব নিতে হিমশিম খেতে হবে এতিমখানা গুলোর। তেমনিভাবে শুধুমাত্র আবির ও তার এতিমখানা নয় বরং হাজারো এতিমখানা এবং হাজারো অসহায় শিশুদের এই দূর্ভোগ পোহাতে হবে।
বিগত বছর গুলোতে বাজারে চামড়ার যথেষ্ট কদর থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে চামড়ার বাজারে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে চামড়ার দামে উর্ধ্বগতি না থাকার কারণে তারা কমদামে চামড়া কিনছেন বা চামড়া ব্যবসায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
চামড়া ব্যবসায়ী রাব্বানী বলেন, আমরা এবার চামড়া কিনে শেষ হয়ে গেছি। যে চামড়া আমরা ৩০০ টাকা দিয়ে কিনেছি তা ১০০ টাকাও বিক্রি করতে পারবো কিনা জানিনা। তাহলে কেন আমরা চামড়া কিনবো।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি বছর দেশে কাঁচা চামড়া উৎপাদিত হয় ১ কোটি ৬৫ লাখ পিস। যার মধ্যে গরুর চামড়া ৫০ লাখ ভেড়া ও মহিষ মিলে ১৫ লাখ পিস। প্রতি বছর কোরবানির ঈদে এ চামড়ার সবচেয়ে বড় যোগান দেয়া হয়। সারা বছর ট্যানারিগুলো মুখিয়ে থাকে কোরবানির ঈদের চামড়া সংগ্রহ করার জন্য।
তবে এবারের ঈদে হঠাৎ করেই ধ্বস নেমেছে এ শিল্পে। এবারে গরু ও ছাগল মিলে প্রায় ৮০ লাখ চামড়া ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন ব্যবসায়ীরা।
ঈদের আগেই চামড়া শিল্পের সঙ্গে জড়িত তিন সংগঠন চামড়া পণ্য ও জুতা প্রস্তুতকারী সমিতি, বাংলাদেশ ট্যানারী অ্যাসোসিয়েশন এবং কাঁচা চামড়া আড়তদারের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন এ বছরের কোরবানির পশুর চামড়ার দামও নির্ধারণ করে দিয়েছিল। নিজেদের সুবিধা বিবেচনা করে চামড়ার দাম নির্ধারণ করেন তারা।
দাম নির্ধারণে সরকারের প্রতিনিধি বা অন্য কোনো পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজনবোধ করেননি তারা। তাদের ঘোষিত এ দামে বিপুল কারসাজির অভিযোগ উঠেছে। খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট (বিএফটিআই) অভিমত প্রকাশ করে বলেছে, চামড়ার দাম আরো বাড়ানোর সুযোগ ছিল।
এতকিছুর পরও কেনও এবার নির্ধারিত দামে চামড়া কিনা হয়নি এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। তারা মনে করছেন এর ফলে দেশের এতিমখানাগুলোতে থাকা শিশুরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
কুমিল্লার সালমানপুর এলাকার ১০ জনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এবার সরকার ও চামড়ার শিল্পের সাথে জড়িতরা আগেই দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। তারপরও কেনও সঠিক দামে চামড়া কিনা হয়নি তা বুঝে আসে না। চামড়া শিল্পের ক্ষতি হলে দেশের অধিকাংশ এতিমখানা নষ্ট হয়ে যাবে বলে মনে করেন তারা। সরকারের কাছে তারা দাবি জানান, চামড়া শিল্প নষ্ট করার পেছনে যারা কাজ করছে তাদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করার।
বছরের অধিকাংশ এতিমখানার খরচ চামড়ার টাকায় চলা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এর মধ্যেই নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
এতিমখানাগুলো প্রতিবারের মতো এবারও চামড়া পেয়েছে তবে নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে না পারা ও চামড়া নষ্ট করে ফেলার কারণে বছরের শুরুতেই ঝামেলায় পড়ে গেছে।
কুমিল্লার রানীরবাজার হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার পরিচালক মাওলানা আবুল কাশেম বলেন, ইসলামে খুব সুন্দর ভাবে চামড়াকে এতিমদের হক বলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে কিছু ব্যবসায়ীর কারণে আজ এতিমরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমরা বছরের শুরুতেই এতিমখানা চালাতে হিমশিম খাচ্ছি।
তবে চামড়া বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন চামড়ার টাকা না পেলে তেমন প্রভাব পড়বে না দেশের এতিমখানায়। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, চামড়া শিল্পের সমস্যার কারণে দেশের এতিমখানায় খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। কারণ দেশের বিভিন্ন দাতা গোষ্ঠী ও বেসরকারী সংস্থা তাদের অনুদান দিয়ে এতিমখানালোকে সাহায্য করবে।
এ বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, দেশের এমিমখানাগুলো শুধুমাত্র চামড়া নির্ভর না। অনেক ব্যক্তি আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকেন।
অন্য সব এতিমদের মতো, আবিরও স্বপ্ন দেখে ভালো মানুষ হওয়ার। মা-বাবা না থাকলেও এতিমখানায় থেকেই স্বপ্নের সমান বড় হতে চায় সে। পথে কোনও বাঁধা স্বপ্নকে আটকে দেবেনা তার। এমন স্বপ্ন দেখে দেশের এতিমখানাগুলো। চামড়া বাজারে পতন প্রভাব ফেলবে না তাদের।
Leave a Reply